আমি আমার দেশে মরতে চাই: এন্ড্রু কিশোর

সময়: 11:29 am - July 6, 2020 | | পঠিত হয়েছে: 156 বার
আমি আমার দেশে মরতে চাই: এন্ড্রু কিশোর

ঢাকা: মৃত্যুর আগাম সংকেত পেয়ে কথাটি বলেছিলেন দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। সিঙ্গাপুরে যখন ক্যানসারের সঙ্গে শেষ লড়াইয়েও কোনো ইতিবাচক ফল আসেনি, তখন তিনি বুঝে গেছেন, হাতে আর বেশি সময় নেই। আর তাই চিকিৎসককে বলেছিলেন, ‘আমাকে আজই রিলিজ করে দাও। আমি দেশে যাবো। আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না।’

জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসেও দেশের প্রতি এমন অগাধ ভালোবাসা দেখিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। সেই কথা প্রকাশ্যে আনলেন তার স্ত্রী ইতি কিশোর। ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে তিনি জানিয়েছেন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকার শেষ সময়ের কিছু ঘটনা।

ইতি কিশোর লিখেছেন, গত বছর, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, আমরা সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। সেখানে কিশোরের ক্যানসার ধরা পড়ে (Diffuse Large B Cell Lymphoma)। তারপর কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি শেষ হয় এপ্রিল মাসে। ডাক্তার বলেন এখন আর কোনও কিছুর দরকার নেই। ঔষধ দিয়ে বলেন, আগস্ট মাসে আসতে। আমরা ১৩ মে দেশে আসার জন্য টিকিট কাটি, কিন্তু কিশোর ভয় পায়। কারণ সে শারীরিক ভাবে খুব দুর্বল ছিল। আমি টিকিট বাতিল করি। ডাক্তার বলেন, এটা কেমোর জন্য, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, সময় লাগবে।

পরে ১০ জুনের টিকিট কাটি, কিন্তু হঠাৎ ২ জুন কিশোরের হালকা জ্বর আসে, ৩ জুন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি করেন ডাক্তার। কিন্তু জ্বর বার বার আসতে থাকে। কোনও ঔষধে তার শরীরে কাজ করছিল না। হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন, পিইটি স্ক্যান করতে হবে, লিম্ফোমা আবার ব্যাক করেছে কিনা দেখতে হবে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, মনে মনে শুধু ঈশ্বরকে ডেকেছি। কারণ শুরুতে ডাক্তার বলেছিলেন, লিম্ফোমা (Lymphoma) যদি একবারে নির্মূল না হয়, যদি ব্যাক করে, তাহলে সেটা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আসে। আর খুব দ্রুত ছড়ায়। এবং সেটা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

৯ জুন পিইটি স্ক্যান হয় এবং সেদিন রাতে ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন যে, পরদিন মানে ১০ জুন সকাল ১০ টায় আমার সাথে পিইটি স্ক্যান রিপোর্ট নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চান। ৯ জুন রাতটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাত। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি, সকালে ১০টার আগে হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকি কিশোরের পাশে।

কিশোর আমাকে বললো, ‘ডাক্তারকে বলবা, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে, আমরা দেশে ফিরবো।’ আমি ভয়ে চুপ করে বসে আছি, শুধু বললাম দেখি ডাক্তার লিম কী বলে। কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বললো ডাক্তার ডাকছে। লিম আমার সামনে এসে একটাই কথা বললো, ‘লিম্ফোমা ব্যাক করেছে।’ আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, কোনও কথা বলতে পারছিলাম না, বুঝলাম সব শেষ। ডাক্তার বললেন, ‘এন্ড্রুকে বলবো?’ আমি বললাম, ‘বলতে তো হবে।’ ডাক্তার আমাকে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে নিয়ে গেলেন এবং দেখালেন। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে কিছু নাই কিন্তু লিম্ফোমা ভাইরাস ডান দিকের লিভার এবং স্পাইনালে ছড়িয়ে গিয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প আছে। আমি কোনও কথা বলতে পারছিলাম না। চোখের জল ঠেকাতে পারছিলাম না, অনেক কষ্টে ডাক্তারকে বললাম, ‘হোয়াট নেক্সট?’ ডাক্তার বললেন, ‘আই অ্যাম স্যরি, আমার আর কিছুই করার নাই।’ আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে।

নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে, কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিশোর বুঝতে পেরেছিল, আমাকে ডাকতে থাকে।

ডাক্তার কিশোরকে বলে লিম্ফোমা ব্যাক করেছে। কিশোর ডাক্তারকে বলে, ‘তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো। আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না। আমি কালই দেশে ফিরবো।’ আমাকে বলে, ‘আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমি তো কাঁদছি না, তুমি কাঁদছ কেন?’ কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল, যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল সেদিন থেকে। কিশোর তখনই বাংলাদেশ হাই কমিশনে ফোন করে বলে, ‘কালই আমার ফেরার ফ্লাইট ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে।’

১০ জুন বিকালে হাসপাতাল থেকে ফিরি এবং ১১ জুন রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরে আসি আমরা।

ঈশ্বরের কী খেলা, ১০ জুন আমরা সম্পূর্ণ পজেটিভ রেজাল্ট নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলাম দেশে। অথচ ১১ জুন ফিরলাম পুরো নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে। আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কতোদিন বাঁচবে। সে আমাকে এটা লিখেছিল “It’s difficult to predict but typically in terms of months rather than years”।

এখন কিশোর কোনও কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাব?

ও বলে, ‘কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে। আর ঈশ্বরকে বলি, আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিয়ো না।’

ক্যানসারের লাস্ট স্টেজে খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের হয়। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।

আমার মনে হলো, কিশোর শুধু আমার বা আমাদের সন্তানের বা আমাদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটা অংশ বা সম্পদ। তাই এই কথাগুলো দেশের ভক্ত-স্রোতাদের বলা বা জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

এটাই আমার শেষ পোস্ট। এরপর আর কিছু বলা বা লেখার মতো আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না, অথচ আমি থাকবো। মেনে নিতে পারছি না।

এই অসময়ে, সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন নেবেন। সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন আর কিশোরের প্রতি ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন। ওর জন্য প্রাণখুলে দোয়া করবেন। বিদায়।

এই বিভাগের আরও খবর