আমাদের গানের সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম

সময়: 11:34 am - July 28, 2020 | | পঠিত হয়েছে: 115 বার
আমাদের গানের সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম

ঢাকা: উপমহাদেশীয় সঙ্গীতে কাজী নজরুল ইসলাম এক ঘোরগ্রস্ত বিস্ময়ের নাম। এই বিস্ময় জাগানিয়া প্রতিভাধর মহান মানুষের অসংখ্য গান আজ পৃথিবীর পথে পথে সৌরভ ছড়াচ্ছে। এই যে মানচিত্র থেকে মানচিত্রে ছড়িয়ে পড়া, এক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন এদেশের গুণী কয়েকজন কণ্ঠশিল্পী। এদের মধ্যে একদম শীর্ষে যার অবস্থান, যাকে নজরুল সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী হিসেবে অভিহিত করা হয়, তিনি ফিরোজা বেগম।

কাজী নজরুল ইসলামের গান ছিলো ফিরোজা বেগমের সাধনা। আর ব্যক্তি নজরুল ইসলাম ছিলেন ফিরোজা বেগমের অনুপ্রেরণা। নজরুল সম্পর্কে ফিরোজা বেগম বলেছিলেন, ‘নজরুল মানবসাধক। বিরল এই সাধকের সানি্নধ্য আমার জীবনের প্রধান স্মৃতি ও প্রেরণা। তাঁর কাছ থেকে গান শিখে আমি প্রবেশ করেছি বাংলা সংগীতের ঐশ্বর্যময় ভুবনে। নজরুলসঙ্গীত আমাকে দিয়েছে নতুন জগতের সন্ধান, যে জগৎ মানবিক সৌন্দর্যে ভরপুর।’ কাজী নজরুল যখন অসুস্থ ছিলেন তখন ফিরোজা বেগমই উদ্যোগ নিয়ে তাঁর গানের শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। নজরুল সঙ্গীতকে পৃথিবীর বহুদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও ফিরোজা বেগম আরো অনেক গুণীজনের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছিলেন। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজ মলি্লক, আব্বাসউদ্দীন, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর কাছে তিনি গানের দীক্ষা লাভ করেন। গান শিখেছিলেন উপমহাদেশের আরেক বিখ্যাত সুরকার, নজরুলের স্নেহধন্য পুরুষ কমল দাশগুপ্তের কাছেও। এই কমল দাশগুপ্তকে পরবর্তীতে ফিরোজা বেগমের জীবনসঙ্গী হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৪২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে ফিরোজা বেগমের ইসলামী গানের রেকর্ড বের করে। এরপর কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড হয়। রেকর্ড হওয়া ‘ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ’ ও ‘প্রীত শিখানে আয়া’ গান দুটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৪৯ সালে নজরুল ইসলামের গান নিয়ে ফিরোজা বেগমের প্রথম রেকর্ড বের হয়। দিন যতই এগিয়ে চলেছে ততই নজরুল সঙ্গীতের সম্মোহনী শক্তি তাঁকে পেয়ে বসেছে। ১৯৬০ সালে তাঁর গাওয়া ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ ও ‘মোমের পুতুল’ গানদুটো সঙ্গীতাঙ্গনে তুমুল আলোড়ন তোলে। ফিরোজা বেগমের গাওয়া নজরুলগীতি এতই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, তাঁর গানের রেকর্ড লাখ লাখ মানুষ কিনতে শুরু করলো। ১৯৬৮ সালে তিনি গাইলেন ‘শাওন রাতে যদি’ গানটি। এই রেকর্ডটি প্রথম সপ্তাহেই দু’লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়। সেসময়ে দু লাখ কপি বিক্রি ছিলো অভাবনীয় ব্যাপার।

ফিরোজা বেগম দীর্ঘ ছয় দশক সঙ্গীতের সাথে মিশে ছিলেন। এই দীর্ঘসময়ের সফল চর্চা ও সাধনা তাঁকে কিংবদন্তীর আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তিনি দেশে বিদেশে প্রায় ৪শ’ একক সঙ্গীতানুষ্ঠান করেছেন। এছাড়াও তিনি শ্রোতাদের জন্যে ১২টি এলপি, ৪টি ইপি, ৬টি সিডি ও ২০টিরও বেশি অডিও ক্যাসেট প্রকাশ করেছেন। তাঁর গাওয়া ‘নূরজাহান নূরজাহান’, ‘আমায় নহে গো’, ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে’, ‘চোখ গেলো চোখ গেলো’, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’, ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’, ‘রুমঝুম রুমঝুম’, ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’, ‘বাঁকা ছুরির মতন’, ‘প্রিয় এমন রাত’, ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ’, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো’, ‘আমি গগনে গহনে সন্ধ্যা তারা’, ‘ওগো প্রিয় তব গান’ ইত্যাদি গানগুলো ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে।

ফিরোজা বেগম নজরুল সঙ্গীত ছাড়াও ঠুমরি,গজল ও আধুনিক গানেও অসামান্য দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন ।হিন্দি ও উর্দুতে তিনি বেশ কিছু স্মরণীয় আধুনিক গান গেয়েছেন ।তবে তাঁর মূল সাধনা ছিল নজরুল সঙ্গীতের বেইজ ঠিক রেখে একে বিকশিত করা ।আজ পুরো উপমহাদেশ জুড়ে নজরুল সঙ্গীতের যে আবেদন তার পেছনে ফিরোজা বেগমের অকৃত্রিম অনুরাগ ও নিরলস অবদান অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে ।তাঁকে যথার্থই নজরুল সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী হিসেবে অভিহিত করা হয় ।

শিল্পচর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে দেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসাবে পরিচিত তাকে “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয়।এছাড়া তিনি একুশে পদক,নেতাজী সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার ,সত্যজিৎ রায় পুরস্কার , নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী স্বর্ণপদক, সেরা নজরুল সঙ্গীতশিল্পী পুরস্কার (একাধিকবার),নজরুল একাডেমিক পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক , বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননা। তিনি জাপানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিবিএস থেকে গোল্ড ডিস্ক, ২০১১ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগমকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা মরণোত্তর ‘বঙ্গবিভূষণ’ প্রদান করছে।

৯০তম জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ডুডল করেছে সার্চজায়ান্ট গুগল। ডুডলে দেখা যাচ্ছে, মাইক্রোফোনের সামনে গান গাইছেন ফিরোজা বেগম। পরনে শাড়ি, গলায় বড় মালা আর খোপায় ফুটে উঠেছে তার চিরাচরিত প্রতিচ্ছবি।

পৃথিবীতে যতদিন সুর থাকবে, ততদিন এই উপমহাদেশের নিপুণ কণ্ঠগুলোর রাজত্ব থাকবে।আর এই রাজত্বের অন্যতম মহারানী হয়ে থাকবেন আমাদের অতি প্রিয় কণ্ঠ শ্রদ্ধেয় ফিরোজা বেগম। তাঁর জন্মদিনে নিউজজি২৪ এর পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা।

এই বিভাগের আরও খবর