আজ মহানায়ক উত্তম কুমারকে শুভেচ্ছা জানানোর দিন

সময়: 6:27 am - September 3, 2021 | | পঠিত হয়েছে: 62 বার
আজ মহানায়ক উত্তম কুমারকে শুভেচ্ছা জানানোর দিন

ঢাকা: বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের ‘মহানায়ক’ খেতাবটি একান্ত নিজের করে নিয়েছেন উত্তম কুমার। সুদর্শন চেহারা, চোখ ধাঁধাঁনো চাহনী আর সুদক্ষ অভিনয় দিয়ে তিনি চলচ্চিত্রকে করেছেন সমৃদ্ধ। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। যেখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের অভিনেতারা।

ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রাখার পর দেখা গেলো আজ ৩ সেপ্টেম্বর। মানে প্রকৃতিতে চলছে শরৎ। আকাশে সাদা মেঘের কুণ্ডলি, কখনো একটুখানি বৃষ্টির ভেজা গল্প আর থেমে থেমে বাতাসের হেলে-দুলে চলা। এসবের ফাঁকে আমাদের মনে পড়ে যায় শরতের এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন সেই শিল্পী, যিনি রীতিমতো পাল্টে দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস। নায়ক রূপে নিজের মতো করে লিখেছেন নতুন মহাকাব্য।

হ্যাঁ, আজ মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্মদিন। তিনি বেঁচে নেই, তবু শুভেচ্ছা জানাতে বাধে কই! হয়ত এই শরতের ঝিরিঝিরি হাওয়ার পালে ভেসে তার কানে ঠিকই পৌঁছে যাবে বিশেষ দিনের এই ভালোবাসা। শুভ জন্মদিন মহানায়ক।

উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে অনুপ্রেরণার একটা জ্বলজ্বলে উদাহরণ পাওয়া যায়। একেবারে ব্যর্থ অবস্থা থেকে একজন মানুষ কীভাবে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করতে পারেন, সেটা উত্তম কুমার দারুণভাবে দেখিয়ে গেছেন।

উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র দুনিয়ায় প্রবেশের আগে তার বেড়ে ওঠার গল্পে ঢুঁ মেরে আসা যাক। তার জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায়। আসল নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার সাউথ সাবার্ন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং গোয়েঙ্কা কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা। অবশ্য চাকরির জন্য গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করতে পারেননি উত্তম।

পরিবারের টানাপোড়েনের কারণে উত্তম কুমারকে শিক্ষাজীবনেই পা বাড়াতে হয়েছে চাকরিতে। কিন্তু ইতিহাস গড়ার জন্য যার জন্ম, তার কি চাকরিতে পড়ে থাকা চলে! মনের ভেতর অভিনয়ের স্বপ্নটা লালন করতে থাকেন উত্তম। তিনি হয়ত জানতেন যে, তার দৌড় বহুদূর। তাই অরুণ থেকে নিজের নাম বদলে রাখেন উত্তম কুমার। ভাগ্যের চাকা ঘুরে কখন জানি এসে পড়ে ডাক; সে আশায় থাকলেন অপেক্ষায়।

অপেক্ষার অবসান হলো ভারত স্বাধীনের বছর। ১৯৪৭ সালে ‘মায়াডোর’ নামের একটি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেলেন উত্তম। কিন্তু না, বড় কোনো চরিত্র নয়; এক্সট্রা আর্টিস্ট হিসেবে। ফলাফল- কারো নজরে না আসা। এরপর ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’- এ অভিনয়। এখানেও তেমন উল্লেখযোগ্য চরিত্র নয়। তার পরের বছর পেলেন মূল চরিত্র। মানে নায়ক। সিনেমার নাম ‘কামনা’। নায়িকা ছবি রায়। সিনেমাটি মুক্তির পর মুখ থুবড়ে পড়ল। একেবারে সুপারফ্লপ! উত্তমের নায়করূপে আত্মপ্রকাশ হলো ভরাডুবির মধ্য দিয়ে।

এখানেই শেষ নয়, এরপর থেকে টানা আট বছরে আটটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। যার সবগুলোই হয়েছে ব্যর্থ। এজন্য তিনি পেয়েছিলেন ‘ফ্লপমাস্টার’- এর খেতাব। সেই ফ্লপমাস্টারই একসময় হয়ে ওঠলেন সুপারস্টার; হিটমাস্টার। কোটি দর্শকের প্রাণের স্পন্দন, তরুণী-যুবতীদের স্বপ্নের নায়ক।

পরিবর্তনের গল্পটা শুরু হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। অবশ্য তার আগে ১৯৫২ সালে ‘বসু পরিবার’ এবং ১৯৫৩ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমায় অভিনয় করে নজর কাড়েন উত্তম কুমার। ৫৪ সালে তিনি চলে আসেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সে বছর তিনি ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। যার অধিকাংশই ছিল সফল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘অগ্নিপরীক্ষা’। এই সিনেমায় জুটি বেঁধে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার ও সুচিত্রা। এরপরই তারা বাংলা সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কালজয়ী জুটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। এই জুটির অভিনীত অন্যতম সিনেমাগুলো হচ্ছে- ‘হারানো সুর’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘সপ্তপদী’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘জীবন তৃষ্ণা’ ও ‘সাগরিকা’।

উত্তম কুমার অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন। বাংলা সিনেমায় তার সিংহভাগ কাজ হলেও হিন্দিতেও তিনি সিনেমা করেছেন। তার অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘মৌচাক’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সবার উপরে’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘নায়ক’, ‘অমানুষ’, ‘ত্রিযামা’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘সদানদের মেলা’, ‘শ্যামলী’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘রাজকুমারী’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘একটি রাত’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘মেম সাহেব’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সেই চোখ’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘নায়িকা সংবাদ’, ‘বন পলাশীর পদাবলী’, ‘দুই পৃথিবী’, ‘শিল্পী’, ‘অভয়ের বিয়ে’, ‘কিতাব’, ‘শাপমোচন’, ‘স্ত্রী’, ‘আগ্নীশ্বর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’ ও ‘ছোটি সি মুলাকাত’ ইত্যাদি।

উত্তম কুমার কেবল বাণিজ্যিক সিনেমায় নায়ক হিসেবে সাফল্যের মালা গলে পরেননি, তিনি বিকল্প ধারায়ও হয়েছেন সফল। তার প্রাপ্তির খাতার দিকে তাকালে সেটার প্রমাণ মেলে। ‘নায়ক’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি‘ ও ‘চিড়িয়াখানা’ সিনেমায় অভিনয় করে সেরা অভিনেতা হিসেবে অর্জন করেছিলেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এছাড়া ‘উত্তর ফাল্গুনী’ সিনেমার জন্য প্রযোজক হিসেবেও পেয়েছেন জাতীয় সম্মান।

ব্যক্তিগত জীবনে উত্তম কুমার বিয়ে করেছিলেন গৌরী দেবীকে। ক্যারিয়ার শুরুর একেবারে প্রথম সময়ে ১৯৪৮ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এই সংসারে তাদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায়। গৌতমের পুত্র গৌরব চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে টালিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা। ১৯৬৩ সালে উত্তম কুমার সংসার ছেড়ে চলে যান। লিভ টুগেদার করেন সেই সময়ের অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবির সঙ্গে। উত্তম কুমারের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৭ বছর তারা একসঙ্গে থেকেছেন।

১৯৮০ সালে ‘ওগো বন্ধু সুন্দরী’ সিনেমার শুটিং চলাকালে স্ট্রোক করেন উত্তম কুমার। এরপত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান। কিন্তু সে বছরের ২৪ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উত্তম। ভবানীপুরে মৃত্যর পর উত্তম কুমারকে কলকাতায় আনা হয়। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর কলকাতায় ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়। কারণ হাজার হাজার ভক্ত রাস্তায় নেমে আসে প্রিয় নায়ককে শেষবারের মতো দেখার জন্য, শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য।

গোটা তিন দশক হয়ে গেছে উত্তম কুমার নেই। কিন্তু তাতে কী! না থেকেও তো তিনি আছেন আরও বেশি গভীরভাবে, দর্শকদের হৃদয়ে।

এই বিভাগের আরও খবর