স্বপ্নপূরণে ব্রুনাইয়ে গিয়ে ‘নিঃস্ব’ হাতে ফিরছেন প্রবাসীরা
ঢাকা: ৩১ অক্টোবর, ২০১৯; ২১ বছরের তরুণ জিয়া মোল্লা মায়ের গহনা বিক্রির টাকা, জমি বিক্রির টাকা ও ধারদেনা করে বহু কষ্টে টাকা জোগাড় করে রিকশাচালক বাবার স্বপ্নপূরণে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে পাড়ি জমিয়েছিলেন ব্রুনাইতে। প্রতি মাসে ব্রুনাইতে তেল কোম্পানির চাকরির বেতন দেয়ার কথা ছিল ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু জিয়া মোল্লার বাবার স্বপ্ন যেন অধরাই থেকে গেলো। ব্রুনাই এয়ারপোর্টে নামার পরে জিয়া বুঝতে পারেন, ব্রুনাইয়ের মূল দালাল মেহেদী হাসান বিজনের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন তিনি। বিজন আবার অপু নামের আরেকজনের কাছে তিনি বিক্রি করে দেন। এরপর ঝামেলা হওয়ার পর একটা গভীর জঙ্গলে তাকে ফেলে রেখে যায় অপু। পশুপাখি ছাড়া সেই জঙ্গলে ছিল না মানুষের কোনও আনাগোনা। ছিল না কোনও খাবারের ব্যবস্থা। এরপর আর কেউ খোঁজ খবর নেয়নি। পরে ভাগ্যক্রমে পুলিশ জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় সেই দেশের জেল খানায়।
এসময় জিয়া মোল্লার সঙ্গে পাচার হওয়া আরও অনেক বাংলাদেশির পাসপোর্ট কেড়ে নেয় পুলিশ। কিছুদিন জেল খাটার পর দেশে পরিবারের লোকদের সঙ্গে কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫৫ হাজার টাকা রেখে দেশের বিমানে পাঠায় তারা। এরপর ২ জানুয়ারি, ২০২০ সালে দেশের মাটিতে পা রাখে রিয়া মোল্লাসহ পাচার হওয়া বাংলাদেশিরা। পুরো ৬০ দিন ব্রুনাইয়ে অমানবিক জীবন অতিবাহিত করে এসব প্রবাসীরা।
জিয়া মোল্লার মতো রফিকুল ইসলাম রাজীব ভালো চাকরির আশায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করে গিয়েছিলেন ব্রুনাইয়ে। তিনি বলেন, ‘ব্রুনাইয়ে যাওয়ার পর অমানবিক জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। দিনের কোনও এক বেলা সামান্য খাবার জুটলেও বাকি দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হয়েছে। এরপরে বাড়ি থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিয়ে খাওয়াদাওয়া করতে হতো। টাকা না দিলে খেতে দিত না, আমাদের ওপর চলতো শারীরিক নির্যাতন। এছাড়াও ব্রুনাইয়ের কোনও ডকুমেন্ট দেখাতে না পারায় আমাদের নির্যাতন করা হতো।’
জিয়া মোল্লা কিংবা রাজীব মতো ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ৩-৪ লাখ টাকা খরচ করে দালাল চক্রের মূলহোতা মেহেদী হাসান বিজনের সহয়তায় ব্রুনাইয়ে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে এসেছেন আরও শত শত বাংলাদেশি। মালেশিয়াতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নামে বর্তমানে সরাসরি কোনও ভিসা দেয়া হয় না। মূলত ব্রুনাই বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানবপাচার কার্যক্রমের রুট এবং গন্তব্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্ট, বাংলাদেশি দালাল চক্র মিলে একটি সংঘবদ্ধ চক্র হয়ে কাজ করছে। এদের উদ্দেশ্য হলো, শ্রমিকদের কাছ থেকে মাসিক সুবিধা আদায় করা, শারীরিক নির্যাতন করা এবং তাদেরকে বেকার রেখে দেশে ফেরত যেতে বাধ্য করা। যাতে তাদের ওয়ার্ক ভিসার বিপরীতে এভাবে আরও কর্মী আনতে পারে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় ব্রুনাইয়ে মানবপাচারকারী দলের বাংলাদেশি প্রতিনিধি শেখ আমিনুর রহমান হিমু। তিনি দালাল চক্রের মূলহোতা মেহেদী হাসান বিজনের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। গ্রেফতার হিমু নড়াইলের সাবেক সংসদ সদস্য পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ব্রুনাইয়ে পাচার করতেন।
মানবপাচারকারী হিমু সম্পর্কে র্যাবের একটি সূত্র জানায়, ব্রুনাইয়ে চাকরি দেওয়ার নাম করে ৪০০ লোকের কাছ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই হিমু। ২০১৯ সালে হিমু ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের মূলহোতা মেহেদী হাসান বিজনের কোম্পানির নামে ভুয়া ডিমান্ড লেটার সংগ্রহ করে ৬০ জন ব্রুনাইয়ে পাঠায়। তারা ঋণ করে ও জমিজমা বিক্রি করে ব্রুনাইয়ে গিয়ে কোনও কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে নিজ খরচে দেশে ফিরে আসে। হিমুর নিজের কোনও রিক্রুটিং লাইসেন্স নেই, সে নজরুল ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ও হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনাল আরএল ব্যবহার করে ব্রুনাইয়ে মানবপাচার করতেন।
র্যাব জানায়, ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের ঘটনায় অসংখ্য ভুক্তভোগী র্যাব-৩ কার্যালয়ে অভিযোগ করে। অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, ব্রুনাইয়ে মানবপাচারের মূলহোতা মেহেদী হাসান বিজন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন অপুর অন্যতম সহযোগী গ্রেফতার শেখ আমিনুর রহমান হিমু। সে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করছিল এবং মেহেদী হাসান বিজনের সাথে তার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী সম্পর্ক। গ্রেফতার হিমু মেহেদী হাসান বিজনের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ব্রুনাই মানবপাচার করতেন। হিমু ব্রুনাইয়ে ভালো ভালো কোম্পানির কথা বলে মানব পাচার করতেন। কিন্তু ব্রুনাইতে সেসব কোম্পানির কোনো খোঁজ মেলেনি।
এ সম্পর্কে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রকিবুল হাসান বলেন, ব্রুনাইয়ে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক অবস্থান করছেন। এসব শ্রমিকদের একটি বড় অংশ মানবপাচারকারী চক্রের মাধ্যমে ব্রুনাই গমন করে বর্তমানে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। ব্রুনাইতে বাংলাদেশি মালিকানায় প্রায় ৩ হাজার কোম্পানি নিবন্ধিত রয়েছে। যার অধিকাংশই নামসর্বস্ব। এসব কোম্পানি ভুয়া বানোয়াট প্রকল্প দেখিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ব্রুনায় থেকে কর্মসংস্থান ভিসা লাভ করে তা দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিক্রি করে। ব্রুনাইয়ে যাওয়ার জন্য এক লাখ বিশ হাজার টাকা নির্ধারণ করা থাকলেও দালালদের মাধ্যেমে প্রায় ৩-৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একজন কর্মীকে ব্রুনায় যেতে হয়।
তিনি বলেন, আইন অনুসারে ব্রুনাইতে একজন কর্মী সর্বোচ্চ দুই বছর অবস্থান করতে পারেন। দুই বছরে অভিবাসন ব্যয়ের টাকা তুলতে না পেরে ভিসার মেয়াদ অতিক্রান্ত করে বাংলাদেশে ফিরে না গিয়ে মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে দুই হাজার ব্রু ডলার দিয়ে পার্শ্ববর্তী সারওয়াক প্রদেশ হয়ে মালেশিয়ার পাচার হয়ে যাচ্ছে। মালেশিয়াতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নামে বর্তমানে কোনও ভিসা দেওয়া হয় না। মূলত ব্রুনাই বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানবপাচার কার্যক্রমের রুট এবং গন্তব্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্ট, বাংলাদেশি দালাল মিলে একটি সংঘবদ্ধ চক্র হয়ে কাজ করছে। এদের উদ্দেশ্য হলো শ্রমিকদের কাছ থেকে মাসিক সুবিধা আদায় করা, শারীরিক নির্যাতন করা এবং তাদেরকে বেকার রেখে দেশে ফেরত যেতে বাধ্য করা। যাতে তাদের ওয়ার্ক ভিসার বিপরীতে এভাবে আরো কর্মী আনতে পারে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা ও নির্যাতনসহ বহুমুখী অপরাধ প্রবণতার কারণে ব্রুনাইয়ে সক্রিয় ভিসা দালাল চক্রের মূলহোতা মেহেদী হাসান বিজনসহ সাত জনের পাসপোর্ট বাতিলের বিষয়ে বাংলাদেশ হাই কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়। পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে পাসপোর্ট অধিদপ্তর মেহেদী হাসান বিজনসহ সাত জনের পাসপোর্ট বাতিল করে
তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার হিমু স্থানীয় সংসদ সদস্য পরিচয় দিতেন। এই পরিচয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেকার-যুবকদের টার্গেট করে ব্রুনাইয়ে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখাতেন। ব্রুনাইয়ের চাকরির কথা বলে প্রতিজনের কাছ থেকে তিন থেকে চার লাখ টাকা নিতেন। কিন্তু ব্রুনাইয়ে কোনো চাকরি না পেয়ে উল্টো জেল খেটে মানবিক জীবন যাপন করেন প্রবাসীরা।
ব্রুনাইয়ে মানবপাচারকারী মূলহোতা কে এই মেহেদী হাসান বিজন : ৯ বছর আগে ২০১১ সালে শ্রমিক হিসেবে ব্রুনাইয়ে যান মেহেদী হাসান বিজন। সেখানে এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এরপর ওই নারীর সঙ্গে যৌথভাবে মিলে আবার কখনো এককভাবে একাধিক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে দেশটিতে শ্রমিক পাঠানো শুরু করেন তিনি। সর্বশেষ ৪ শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩ কোটি টাকা নিয়ে মাত্র ৬০ জনকে ব্রুনাইয়ে নিয়ে যান তিনি। সেখানে নেওয়ার পর এই ৬০ জনের কাউকেই কোনও কাজ দেওয়া হয়নি, ফলে ব্রুনাইয়ের রাস্তায় দিন কাটতে থাকে ভুক্তভোগীদের। পরে করোনা মহামারীর সময় নিজ নিজ পরিবারের আর্থিক সহযোগিতায় গত জানুয়ারি মাসে দেশে ফিরে আসেন তারা। ভুক্তভোগীরা মেহেদী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মানবপাচার ও প্রতারণার আইনে কমপক্ষে ২০টি মামলা করেন।
জানা গেছে, ব্রুনাইয়ে থাকার সময় মেহেদী বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। সেখানে তিনি বিলাসবহুল বুলেটপ্রুফ হামার এইচ-২ গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সেই গাড়ির নম্বরটি ছিল তার মোবাইল ফোনের নাম্বারের সঙ্গে মেলানো। পরবর্তীতে প্রতারণার অভিযোগে মেহেদী হাসান ও তার সাত সহযোগীর পাসপোর্ট বাতিল করে দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয় দেশটির সরকার। বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের সময় গত ফেব্রুয়ারি মাসে মেহেদী হাসান বিজনসহ পাঁচজন দেশে ফেরত আসেন।
দেশে থেকেও আত্মগোপনে মূলহোতা বিজন : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার জনকে পাচার করা হয়েছে। হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। বিজন ও তার অন্য সহযোগীরা ঢাকায়ই আছেন। কৌশলে গাঢাকা দিয়েছেন। ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি এড়িয়ে চলছেন। সর্বশেষ রাজধানীর কাফরুল থানায় দুটি মামলা করেন প্রতারণার শিকার ব্রুনাইয়ে যাওয়ার পর ফিরে আসা দুই ভুক্তভোগী। মামলা নং- ৩৫ ও ৩৬। দুই মামলায়ই চক্রের মূলহোতা হিসেবে উঠে এসেছে বিজনের নাম।
এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার সামসুন নাহার বলেন, মানবপাচারের পাঁচটি মামলা আমাদের টিম তদন্ত করছে। অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট তদন্ত করছে একটি। মেহেদী হাসান বিজনের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনার গত ৩ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দেন। সেটি আসে সিআইডির হাতে। পরে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিজনের সহযোগীদের গ্রেফতার করা হয়।