আজীবন গানেই বেঁচে থাকবেন লাকী আখন্দ
ঢাকা: কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা, সঙ্গীতশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখন্দ। সফট-মেলোডি, মেলো-রক, হার্ড-রক সব ধরণের গানই তার ছোঁয়ায় অতুলনীয় হয়ে উঠতো। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা লাকী আখন্দ ছিলেন আশির দশকের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক।
১৯৫৬ সালের ৭ জুন ঢাকার পাতলা খান লেন এলাকায় লাকি আখন্দ জন্মগ্রহণ করেন। তার গানে হাতেখড়ি বাবার কাছ থেকে। পাকিস্তান আমলে তিনি টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসেবে গানের জগতে পা রাখেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ভারতের এইচএমভি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম অন্তর্ভূক্ত করেন কিংবদন্তী এই শিল্পী।
১৯৭৫ সালে লাকী আখন্দ তার ছোট ভাই হ্যাপী আখন্দের একটি অ্যালবামের সঙ্গীতায়োজন করেন। অ্যালবামটিতে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ ও ‘কে বাঁশি বাজায়রে’ গানে কণ্ঠ দেন হ্যাপী আখন্দ, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে’ ও ‘পাহাড়ি ঝর্ণা’ গানে কণ্ঠ দেন হ্যাপী ও লাকী দুজনে, এবং লাকী নিজে ‘নীল নীল শাড়ি পরে’ ও ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ’ গানে কণ্ঠ দেন। আখন্দ ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ঘুড্ডি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
এই চলচ্চিত্রে হ্যাপী আখন্দের পূর্বের অ্যালবামের ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি ব্যবহৃত হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৪ সালে সারগামের ব্যানারে প্রথমবারের মতো একক অ্যালবাম বের করেন লাকী আখন্দ। ওই অ্যালবামের ‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘রীতিনীতি জানি না’, ‘মা মনিয়া’, ‘আগে যদি জানতাম’ গানগুলো শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এরপর থেকে বিখ্যাত সব জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে বাংলা সঙ্গীত জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন প্রিয় এই শিল্পী।
আখন্দের ছোট ভাই হ্যাপী আখন্দ ১৯৮৭ সালে মারা যাওয়ার পর হঠাৎ করে তিনি সঙ্গীতচর্চা বন্ধ করে দেন। প্রায় এক যুগ পরে ১৯৯৮ সালে ‘পরিচয় কবে হবে’ ও ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ অ্যালবামের সঙ্গীতায়োজনের মাধ্যমে আবারও গানের ভুবনে ফিরেন। ‘পরিচয় কবে হবে’ ছিল তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম এবং হ্যাপী আখন্দের একক অ্যালবাম শেষ উপহার-এর রিমেক। ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ ছিল ব্যান্ড ও আধুনিক গানের মিশ্র অ্যালবাম।
এতে সেসময়ের ছয়জন জনপ্রিয় গায়ক, মাহফুজ আনাম জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, ও সামিনা চৌধুরী কণ্ঠ দেন। একই বছর তিনি সামিনা চৌধুরীকে নিয়ে আনন্দ চোখ নামে একটি দ্বৈত অ্যালবাম প্রকাশ করেন।
পরের বছর সামিনা চৌধুরীর একক অ্যালবাম ‘আমায় ডেকোনা’র সঙ্গীতায়োজন করেন লাকী। এছাড়া তিনি ব্যান্ডদল আর্কের ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা’ গানের সুর করেন। ২০০০ সালের পর তিনি আরেকটি মিশ্র অ্যালবাম ‘তোমার অরণ্যে’র সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেন।
এতে লাকী আখন্দের কণ্ঠে গাওয়া ৩টি গানসহ বাপ্পা মজুমদার, ফাহমিদা নবী, ও নিপুর কণ্ঠে ১০টি গান ছিল। তিনি এই অ্যালবামে সমকালীন তাল, লোক গানের তাল ও তার প্রিয় স্পেনীয় গানের তাল ব্যবহার করেন। তার নিজের সুর করা গানের সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি।
কালজয়ী এ শিল্পীর সুর করা গানে বিখ্যাত হয়েছেন বর্তমান যুগের অনেক জনপ্রিয় শিল্পীরা। তার সুরে কুমার বিশ্বজিৎ গেয়েছেন ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, সামিনা চৌধুরী গেয়েছেন ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে‘, ফেরদৌস ওয়াহিদ গেয়েছেন ‘আগে যদি জানতাম, তবে মন ফিরে চাইতাম’ এবং জেমস রকস্টাইলে গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন ‘লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া’।
তার উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘চল না ঘুরে আসি’, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘এই নীল মনিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘মামনিয়া, ‘বিতৃঞ্চা জীবনে আমার’, ‘কি করে বললে তুমি’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘হৃদয় আমার’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান, ‘ভালোবেসে চলে যেও না’ প্রভৃতি।
লাকী আখন্দের বেশ সমৃদ্ধ ও পরিচিত বেশ কিছু অ্যালবাম রয়েছে। সেগুলো হলো (১৯৮৪) পরিচয় কবে হবে (১৯৯৮), বিতৃষ্ণা জীবনে আমার (১৯৯৮), আনন্দ চোখ (১৯৯৯), আমায় ডেকো না (১৯৯৯), দেখা হবে বন্ধু (১৯৯৯)। ক্ষণজন্মা এই শিল্পী গান গাওয়ার পাশাপাশি সুর করেছেন অন্য শিল্পীদের জন্যে।
কালজয়ী এই শিল্পীর প্রিয় গানগুলো আজও তার ভক্তদের হৃদয়ে গুন গুন করে বাজে। তবে কিংবদন্তির দ্বিতীয মৃত্যুবার্ষিকীতে তেমন কোনো আয়োজন নেই। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গন তাকে স্মরণ করে কোনো আয়োজনই রাখেনি।
লাকী আখন্দ তার সুর এবং সঙ্গীতায়োজনেও নান্দনিক বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনায় দেখিয়েছেন নতুন নতুন চমক। তিনি ব্যান্ড দল ‘হ্যাপী টাচ’র সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় রেডিও নেটওয়ার্ক এর পরিচালক (সঙ্গীত) হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৬৯ সালে লাকী আখন্দ পাকিস্তানী আর্ট কাউন্সিল থেকে ‘বাংলা আধুনিক গান’ বিভাগে পুরস্কার লাভ করেন।
২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর লাকী আখন্দের ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর তাকে ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। থাইল্যান্ডের পায়থাই হাসপাতালে তার যকৃতে অস্ত্রোপচারও করা হয়। এরপর দেশে এসে কিছুদিন থাকার পর একই বছরের নভেম্বরে আবারও ব্যাংককে গিয়ে শরীরে ছয়টি কেমও নিতে হয়েছিল তাকে। কেমও শেষ করে ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ দেশে ফেরেন তিনি। ২০১৭ সালের প্রথম তিন মাস ঢাকার তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন লাকি আখন্দ। তার শরীরে মোট নয়টি কেমও দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল ৬১ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি দিয়েছিলেন এ কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী।
‘এই নীল মনিহার’, ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ এবং ‘আমায় ডেকো না’ বিখ্যাত এই গানগুলোর স্রষ্টা লাকী আখন্দ গেল দু’বছর থেকে আমাদের মাঝে নেই। স্বশরীরে তিনি না থাকলেও রেখে গেছেন কালজয়ী অসংখ্য গান। যা দিয়ে আজীবন ভক্তদের মনে গেঁথে থাকবেন গানের এই বরপুত্র। তার অমর সৃষ্টি এমনিভাবেই তাকে সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল।