২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: এবার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পালা
ঢাকা: ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার ঠিক আগে উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা ও গুলিবর্ষণে ঘটনা স্থলে দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ অন্তত ২৪ জন মারা যান। আহত হন তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেকেই৷
১৯৯৯ সালে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হরকাতুল জিহাদ বা হুজি-বি গঠন করে আফগানফেরত যোদ্ধারা। তাদের ভারি অস্ত্রের প্রশিক্ষণ ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থাকায় দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে জঙ্গি সংগঠনটি। ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে হুজি-বি’র জঙ্গিরা। কোটালিপাড়ায় জনসভার মাঠে ৭৬ কেজি বোমা পুতে শেখ হাসিনাকে হত্যারও চেষ্টা চালিয়েছিল তারা। এছাড়াও আরো তিনবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায় তারা। এর মধ্যে ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।
শেখ হাসিনাকে হত্যা চেস্টার বাইরে রমনা বটমূল, উদীচীর সমাবেশ, ব্রিটিশ হাইকমিশনের ওপরে হামলাসহ ১৭টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি-বি। এসব হামলায় নিহত হন ১৪৫ জন। আহত হন প্রায় এক হাজার মানুষ।
ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে ভয়াবহ নজিরবিহীন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ ২৪ জন নিহত হন। এর মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান। আহত হন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ দলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং কয়েক’শ নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষ।
সেই রক্তস্নাত ভয়াবহ বিভীষিকাময় দিন শনিবার ২১ আগস্ট। বর্বরোচিত ও বীভৎস হত্যাযজ্ঞের দিন। মৃত্যু ও রক্তস্রোতের নারকীয় নজিরবিহীন গ্রেনেড হামলার ১৭তম বার্ষিকী। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে এই নারকীয় হত্যাকান্ড চালানো হয় ২০০৪ সালের এই দিনে। নিত্য প্রাণবন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ ওইদিন মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। সেদিন যদি ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকে বিস্ফোরিত হতো তবে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কোন সিনিয়র নেতাই প্রাণে রক্ষা পেতেন না। আর এটিই ছিল ঘাতকচক্রের মূল পরিকল্পনা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ওই দিনটি ছিল শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। হাজার হাজার মানুষের সমাগম ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের চতুর্দিকে। সমাবেশ শেষে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জে চেপে বিকেল ৫টার একটু আগে সমাবেশস্থলে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সময় তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট।
‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে শেখ হাসিনার বক্তৃতা শেষের মুহূর্তেই শুরু হলো নারকীয় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগল একের পর এক যুদ্ধে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড। আর প্রাণবন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় ঘাতকরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তুপে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সমাবেশস্থল। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ট্রাকে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ মূহুর্তেই মানবঢাল রচনা করে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে। ওইদিন হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কান ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
জঘন্যতম ওই ঘটনায় আনা মামলায় সব পক্ষকে বিদ্যমান সকল আইনি সুবিধা দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণা করেন। বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত মামলা এখন হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিচারিক আদালতের রায়ে, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন দুই শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ড দেন বিচারিক আদালত। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ জন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) সদস্য। এছাড়া রায়ে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও অপর ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডসহ অর্থদন্ড দেয়া হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ আসামিকে মৃত্যুদন্ড ও এক লাখ টাকা করে অর্থদন্ড দেয়া হয়। তারা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (সম্প্রতি মারা গেছেন), হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ বাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। তারা হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও আরিফুল ইসলাম আরিফ, জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।
এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে দন্ডিত ১১ জন হলেন- মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, জোট সরকার আমলের তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমীন।
জঙ্গিরা তৎকালীন ক্ষমতাসীন মহলের প্রত্যক্ষ মদদ ও সহায়তায় বর্বরোচিত এ মামলা চালায় শান্তিপ্রিয় আওয়ামী লীগ ও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ সমাবেশের ওপর। তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন ওই ঘটনায় নিহত হন। মারাত্মক আহত হন কয়েকশো নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেকে ওই ঘটনার শিকার হয়ে দেহে এর ক্ষত বহন করছেন।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের মুখপাত্র ও বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার নথিপত্র অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করে পেপার বুক তৈরী করে যাবতীয় প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিধি অনুসারে শিগগিরই শুনানির পদক্ষেপ নেয়া হবে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ইতিহাসের জঘন্যতম ঘৃণ্য ঘটনা। এরইমধ্যে এই মামলায় বিচারিক আদালতে দন্ডিত পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখন এ মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে।
বিচারিক আদালতে এই মামলার রাষ্ট্র পক্ষের প্রধান কৌসুঁলি সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় এই হামলা চালানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মাদার অব হিউম্যানিটি, সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশুন্য ও দেশকে অকার্যকর করাই ছিল ওই হামলার উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, ওই হামলায় সমরাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়।
সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আর্জেস গ্রেনেডের স্প্রিন্টার দেহে বহন করে অসুস্থ হয়ে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন ঢাকার সাবেক মেয়র ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ। এখন হাইকোর্টে দ্রুত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার শুনানি হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই বিভিন্ন মামলার শুনানি চলছে। তবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলা। এখানে অনেক আসামি। অনেক আইনজীবী যুক্ত। তাই এই মামলা ভার্চুয়ালি শুনানি কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে তা নিয়েই আমার প্রশ্ন।