তিন দফায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি সংগ্রামে ৪৩ বছরে দলটি

সময়: 7:32 am - September 1, 2020 | | পঠিত হয়েছে: 72 বার
আমন্ত্রণ পেলে ভারত সফরে যেতে আগ্রহী বিএনপি

ঢাকা: টানা তিন দফা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি মামলা ও গ্রেফতারে নেতাকর্মীদের নাজেহাল অবস্থা। সবমিলে দলটি বর্তমানে চরম দুঃসময় পার করছে। একইসঙ্গে এই দুঃসময়ে নানা কারণে সক্রিয়ভাবে পাশে থাকতে পারছেন না দলের দুজন মূলস্তম্ভ- চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ অবস্থায় বর্তমান সংকট কাটিয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে ঘুরে দাঁড়ানোই বিএনপির এখন মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমন পরিস্থিতিতেই আজ উদযাপিত হচ্ছে বিএনপির ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭৮ সালের এই দিনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দলটির প্রতিষ্ঠা করেন। করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে দলের ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একদিনের কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।

এরই অংশ হিসেবে মঙ্গলবার (১ সেপ্টেম্বর) ভোর ৬টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশের কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১১টায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা শেরে বাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর সাড়ে ১১টায় মহানগর দক্ষিণ ও বেলা ১২টায় উত্তরের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বিকেল তিনটায় বিএনপির উদ্যোগে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা হবে। কেন্দ্রীয় এই কর্মসূচির অনুরূপ সারাদেশে জেলা-উপজেলায়ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি যথাযোগ্যভাবে পালিত হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পোস্টার ছাপানো হয়েছে এবং বিশেষ ক্রোড়পত্রও প্রকাশ হয়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে দলের নেতাকর্মী, সমর্থক ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হন। ৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন; ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭ এর ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যেতে হয়, জিয়া তখন ওই দায়িত্বও নেন। সে সময় জিয়ার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টায় একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়, যাতে ৯৮.৯ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে।

সামরিক আইন প্রশাসক থাকা অবস্থায় জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি ডানপন্থি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়। তবে সে দল তখন দেশের রাজনীতিতে নাড়া দিতে পারেনি। ওই বছর ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধানের পদে থেকে পুরাদস্তুর রাজনীতিবিদ বনে যান জিয়া। ৩ জুন নির্বাচন দিয়ে ওই ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি ‘নির্বাচিত’ রাষ্ট্রপতি হন।

নির্বাচনের তিন মাসের মাথায় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।

জাগদল, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ন্যাপ, আবদুল হালিম-আকবর হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি ও শাহ আজিজুর রহমানের মুসলিম লীগ বিলীন হয় জিয়ার বিএনপিতে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। ২০১০ সালে সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায়ে জিয়ার ক্ষমতাগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত।

জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার এক বছরের মধ্যে রাজনীতিতে নেমেই দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদ নেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তখন বিএনপির চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ১৯৮২ সালে বিএনপি হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে সাত্তারের অসুস্থতার মধ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের পদ নিয়ে দলের হাল ধরেন খালেদা জিয়া। তারপর ১৯৮৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন তিনি।

সেই থেকে বেগম জিয়া এই পদে আসীন রয়েছেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার পর দুই বার তার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর ৫ বছর সংসদের বাইরে থাকতে হয় বিএনপিকে। কয়েক দফা সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেও সফল হননি খালেদা জিয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের কঠোরতার কারণে।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ মামলার সাজায় কারাগারে যেতে হলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ছেলে তারেক রহমান, যিনি গত এক যুগ ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে দেশে তিনটি মামলায় তার সাজার রায় এসেছে। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই ২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তাতে চরম ভরাডুবির পর সরকারের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তোলেন বিএনপি নেতারা।

গত ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার পর থেকে নিজের বাসাতেই আছেন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যে তার দণ্ড স্থগিতের মেয়াদ বাড়াতে সরকারের কাছে আবেদন করেছে তার পরিবার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, নেতাকর্মীদের মাঝে আস্থা ও মনোবল ফিরিয়ে আনতে সঠিক ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। সুবিধাবাদীদের বাদ দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগীদের সামনে এনে দ্রুত দল পুনর্গঠনে হাত দেয়ার পরামর্শ দেন তারা। তাদের মতে, প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময়ে বিপর্যয়ে পড়ে দলটি। কিন্তু বারবারই তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এবারও দলটি ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা তাদের। কারণ এদেশের লাখ লাখ তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থক জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন  বলেন, ‘বিএনপির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রথমে উচিত দলকে সুসংহত করা। জিয়াউর রহমানের আদর্শে সবাইকে উজ্জীবিত করা এবং ওই যৌক্তিকতায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করা। দলকে সংঘবদ্ধ করা।’ ‘বিএনপির কিছু ভুলও রয়েছে’ উল্লেখ করে দলটির এই নীতিনির্ধারক বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে দূরে থাকা বিএনপির মারাত্মক ভুল। এছাড়া একতাবদ্ধ না হওয়া এবং জনগণকে সম্পৃক্ত না করাটাও বিএনপির রাজনীতির নেতিবাচক দিক। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিএনপি একা এ অবস্থা থেকে দেশকে বের করে আনতে পারবে না। সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে সর্বদলীয় ঐক্যের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে।’

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে যৌথ নেতৃত্বে চলছে বিএনপি। তিনি লন্ডনে বসে দল পরিচালনা করছেন। খালেদা জিয়া শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পেলেও ২৫ মার্চ থেকে তিনি গুলশানের বাসায় অবস্থান করছেন। তবে, আইনি জটিলতার কারনে দলীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারছেন না।

জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘টানা তিন দফায় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। স্বাভাবিকভাবে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিএনপির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক, কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। অবশ্য মামলা-হামলার কারণে নেতাকর্মীরা বেকায়দায় রয়েছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, তা চেষ্টা করছে বিএনপি। দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারলে দলটির জন্য ভালো তো বটেই, দেশের জন্যও ভালো। তবে এ সময়টা কবে আসবে, বলা কঠিন। এটাও ঠিক, জামায়াতকে ত্যাগ করতে পারলে বিএনপির ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগবে না।’

এদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে দলের সবস্তলের নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী এবং দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একইসঙ্গে বর্তমান সরকারের এই জুলুম নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্য গড়ে তুলতে এবং দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে এককাতারে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

একইসঙ্গে বিএনপি’র ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আগামী দিনে হারানো ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা এবং বাক-ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ জনগণের মানবিক মর্যাদা সুরক্ষা করাই নেতাকর্মীদের আন্দোলনের লক্ষ্য হবে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেন তারেক রহমান।

অপর এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বাণীতে বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে হয়রানির খড়গ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার শিকার। কারণ তিনিই গণতন্ত্রের প্রতীক এবং জনগণের নাগরিক ও বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে প্রধান কন্ঠস্বর। পাশাপাশি দেশের যে কোন ক্রান্তিলগ্নে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থেকে অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। বিএনপি’র ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আমি দেশবাসীকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাই।’

এই বিভাগের আরও খবর